-জামিলুর রহমান
ভূমিকা :
বিয়ে একটি সামজিক প্রথা যার মাধ্যমে দুজন নারী ও পুরুষ পারস্পরিক বন্ধনের দ্বারা তাদের দাম্পত্য জীবনের সূচনা করে। দেশ, জাতী, ধর্ম ও সংস্কৃতি অনুসারে প্রথাটি ভিন্ন হলেও সাধারণভাবে বিবাহ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে একটি দম্পতির আধ্যাত্মিক ও শারীরিক বন্ধনকে সমাজ স্বীকৃতি প্রদান করে। বিবাহ প্রথা সভ্য সমাজের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। বিবাহকে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তি হিসেবেও বিবেচনা করা হয়, যে চুক্তিটি সম্পাদনে রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় বা উভয় কর্তৃপক্ষ সাহায্য করে। চুক্তি সম্পাদনের পর সামাজিক রীতি অনুসারে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা চলে। বিবাহের পর দুজনের মধ্যে পারস্পরিক দায়িত্ববোধ, অধিকার, সুযোগ-সুবিধা তৈরি হয় যেখানে একটি নতুন পরিবারের আত্মপ্রকাশ ঘটে। মানব সভ্যতার সাথে বিয়ের সম্পর্কটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটা যেমন সত্য যে প্রতিটি সভ্যতার পিছনে কোন না কোন ধর্মের ভূমিকা রয়েছে, তেমনিভাবে বিবাহ প্রথাও ঐ ধর্মকে সৌন্দযমন্ডিত করেছে। বিবাহ নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি সৃষ্টিতে এবং অবক্ষয়মুক্ত সমাজ গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
বাহাই বিবাহের উদ্দেশ্য :
বিবাহের উদ্দেশ্যই হলো একটি পরিবার সৃষ্টি করা। সভ্য সমাজে আমরা সবাই যে কোন একটি পরিবারের সদস্য। পরিবারের মধ্যে আমরা জন্মগ্রহণ করি, লালিত-পালিত হই। পরিবার একটি স্থায়ী ও একক সামাজিক সংগঠন। এখানে এর সদস্যরা আমরণ একত্রে বসবাস করার চেষ্টা করে। শান্তিময় পরিবারই শান্তিময় সমাজ সৃষ্টিতে মূখ্য, যার পরিণাম শান্তিময় পৃথিবী। বিবাহের মাধ্যমে সৃষ্ট এই পরিবার হলো: নারী-পুরুষের মধ্যে বৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জায়গা, সন্তান প্রজনন ও সুষ্ঠভাবে তাদের প্রতিপালনের স্থান, আবাস স্থানের মাধ্যমে একটি নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় গৃহ সৃষ্টি, সামাজিক রীতি-নীতি, আচার- অনুষ্ঠান এবং ধর্মীয় ও নৈতিক আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সামাজিকিকরণের স্থান। এই পারিবারিক জীবন অশান্ত ও ভঙ্গুর হলে সমাজে তার প্রভাব পড়ে, নানা অস্থিরতা ও বিপর্যয় দেখা দেয়। এজন্য সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন পরিবারই কল্যাণকর সমাজের ভিত্তি এবং আদর্শ সমাজ গঠনের অপরিহার্য শর্ত।
যেহেতু বিবাহের মাধ্যমে পরিবারের সৃষ্টি হয় এবং এই পরিবারই মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে এবং তার গঠনমূলক বিকাশে ভূমিকা রাখে, সেহেতু সুন্দর বিবাহ যেন সমাজে চলমান থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। বিবাহ ছাড়া সমাজ গঠন কোন মতেই সম্ভব নয়, তাই একে এড়িয়ে চলার অর্থ সুন্দর সমাজ গঠনের প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে যাওয়া।
এখন আমরা বাহাই বিবাহের প্রতি আলোকপাত করবো যেটি একটি সভ্য, সুন্দর, উদীয়মান, প্রগতিশীল, নৈতিক উৎকর্ষতায় পরিপূর্ণ একটি সমাজ গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাইতো বাহাই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহান বাহাউল্লাহ তাঁর মহাপবিত্র গ্রন্থ কিতাব-ই-আক্বদাসে মানুষকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে উৎসাহ দিয়ে বলেছেন, “হে লোকসকল, বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হও, যাহাতে তোমরা এমন একজনকে জন্ম দিতে পার, যে আমার ভৃত্যদের মধ্যে আমার নাম উল্লেখ করিবে।” (পৃষ্ঠা ৪১ এর ৬৩ নং অনুচ্ছেদ)। বাহাই ধর্মে সন্ন্যাস জীবন ও বৈরাগ্যকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি এ সম্পর্কে আরো বলেন, “নির্জন বাস অথবা কঠোর সংযম চর্চা ঈশ্বরের সমক্ষে গ্রহণযোগ্য নহে,” এবং যারা এতে বিজড়িত তাদেরকে “যাহা কিছু আনন্দ ও উজ্জ্বলতা ঘটাইবে তাহা পালন করিতে” আহ্বান করেন, যারা “পাহাড়-পর্বত-গুহায়” তাদের গৃহ স্থাপন করেছে, অথবা যারা “রাত্রে কবরস্থানে গমন করে”, তাদেরকে এইসব প্রথা পরিত্যাগ করতে এবং মানব জাতির জন্য ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট এই জগতের “দানসমূহ” থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত না করতে আদেশ করেন। এবং বিশারতের ফলকলিপিতে সন্ন্যাসীদের ও পুরোহিতদের “সৎ কার্যাবলী” এর প্রতি স্বীকৃতিপূর্বক, বাহাউল্লাহ তাদেরকে “নির্জন জীবনযাপন পরিত্যাগ করিতে এবং মুক্ত পৃথিবীতে তাহাদের পদক্ষেপগুলি পরিচালনা করিতে এবং যাহা কিছু তাহাদেরকে ও অন্যদের উপকার করিবে তাহা নিয়া তাহাদেরকে ব্যস্ত রাখিতে আহ্বান করেনা” (কিতাব-ই-আক্বদাস: পৃষ্ঠা ১৯৬ এর ৬১ নং টীকা)। বাহাউল্লাহ বলেছেন, “যিশু খৃষ্টের-তাঁহার উপর ঈশ্বরের শান্তি বর্ষিত হউক-অনুসারীদের মধ্যে মঠধারী সন্নাসীদের ও পুরোহিতদের আচার নিষ্ঠ কার্যাবলী তাঁহার উপস্থিতিতে স্মরণ করা হয়। কিন্তু এই যুগে তাহারা নির্জন জীবন পরিত্যাগ করিবে, এবং মুক্ত পৃথিবীর দিকে পদক্ষেপ করিবে, এবং যাহা কিছু তাহাদিগকে ও অন্যদেরকে লাভবান করে, উহাতে ব্যস্ত রাখিবে। আমরা তাহাদিগকে বিবাহে আবদ্ধ হইতে অনুমতি দান করিয়াছি, যাহাতে তাহারা কাহাকেও জন্মদান করিবে, যে ঈশ্বরের নাম উল্লেখ করিবে, যিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যের পরম প্রভু, মহা সমুন্নত সিংহাসনের পরম প্রভু।” (বাহাউল্লাহ, বাব ও আব্দুল-বাহার পবিত্র লেখনাবলী হইতে সংকলিত: পৃষ্ঠা ৭৭, অষ্ঠম সুসমাচার)।
বাহাই বিবাহ কেবল জাগতিক নয় এটি একটি আধ্যাত্মিক অনন্ত কালের বন্ধন যেটি মৃত্যুর পরেও স্থায়ী থাকে। বাহাই ধর্মের ব্যাখ্যাকারী মহান আব্দুল-বাহা বলেছেন, “….বাহা’র জনমন্ডলীর মধ্যে বিবাহ অবশ্যই দেহ ও মনের একটি মিলন রূপে গণ্য করিতে হইবে, কারণ এখানে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই একই মদিরায় উজ্জ্বীবিত, উভয়েই একই অনুপম আননের প্রণয়াসক্ত, উভয়ে একই শক্তির মাধ্যমে জীবন ধারণ করে ও চলাচল করে, উভয়েই একই দীপ্তির দ্বারা আলোকিত। উভয়ের মধ্যে এই সংযোগ হইতেছে একটি আধ্যাত্মিক ব্যাপার এই জন্য ইহা একটি বন্ধন যাহা চিরকাল স্থায়ী থাকিবে…….. যখন বাহা’র জনগণ বিবাহ করিবে, ঐ মিলন অবশ্যই প্রকৃত সম্পর্কযুক্ত হইবে, যাহা একটি আধ্যাত্মিক ও শারীরিক আবির্ভাবের মিলন, এই জন্যই যে, জীবনের প্রতিটি ধাপে সর্বত্রই, এবং ঈশ্বরের সমস্ত জগতসমূহের, তাহাদের সংযোগ স্থায়ী হইবে।” (বাহাউল্লাহ, বাব ও আব্দুল-বাহার পবিত্র লেখনাবলী হইতে সংকলিত: ১৫ নং অনুচ্ছেদ, পৃষ্ঠা ১৮৫)।
বিবাহ করা বাধ্যতামূলক নয় :
বাহাউল্লাহ প্রতিটি সক্ষম ও সুস্থ মানুষকে বিয়ের জন্য উৎসাহিত করেছেন বটে, তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়। (কিতাব-ই-আক্বদাস, প্রশ্ন ও উত্তর, নং ৪৬, পৃষ্ঠা ১১৭)। বাহাই ধর্মের অভিভাবক শৌগী এফেন্দীও তাঁর পক্ষ হতে লিখিত একটি পত্রে ঘোষণা করেন যে, “বিবাহ কোন মতেই বাধ্যতামূলক নয়,” এবং তিনি দৃঢ়রূপে বলেন যে, “শেষ উপায় হিসেবে ইহা ব্যক্তিটির স্থির করার বিষয় যে, সে পারিবারিক জীবনযাপন করতে ইচ্ছা করে, না কৌমার্যের অবস্থায় জীবনযাপন করতে ইচ্ছা করে।” যদি একজনকে একটি স্বামী অথবা স্ত্রী খুঁজে পাওয়ার পূর্বে বেশ কিছুকাল অপেক্ষা করতে হয়, অথবা শেষ পযর্ন্ত একাকী জীবনযাপন করতে হয়, তার অর্থ এই নয় যে এর ফলে ব্যক্তিটি তার জীবনের উদ্দেশ্য পূরণ করতে অসমর্থ হয়েছে, যা মূলতঃ আধ্যাত্মিক। (কিতাব-ই-আক্বদাস, টীকা নং ৯১, পৃষ্ঠা ২০৮)
বাহাই বিবাহের শর্তাবলী:
যেহেতু বাহাই বিবাহের উদ্দেশ্য কেবল শারীরিক মিলন নয়, বরং এটি আধ্যাত্মিক ও ঈশ্বরের সমস্ত জগতে স্থায়ী থাকে। এটি কেবল স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বন্ধন নয়, বরং দুটি পরিবারের বন্ধন। তাই বিবাহের মাধ্যমে সৃষ্ট পরিবারটিকে সুখী ও সমৃদ্ধ করার জন্য আবশ্যকীয় শর্তাবলী বিদ্যমান।
শর্ত ১: ৬ জনের সম্মতি:
প্রথমে ছেলে ও মেয়ে উভয়ে উভয়কে পছন্দ করবে, কাওকে কারো সাথে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া যাবে না। উভয়ে উভয়কে পছন্দ করলে জীবিত পিতা-মাতার সম্মতি গ্রহণ আবশ্যক। সম্মতিদানের ব্যাপারে মহান বাহাউল্লাহ বলেন, “… আমাদের ভৃত্যদের মধ্যে ভালবাসা, ঐক্য ও সমতা প্রতিষ্ঠাকল্পে, যুগলটির ইচ্ছা জানিবার পর মাতা-পিতার অনুমতি আমরা শর্তমূলক করিয়াছি, যেন তাহাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষের উদ্ভব না হয়।” ছেলে ও মেয়ের নিজেদের পছন্দ ও বাবা-মায়ের অনুমতি সম্পর্কে আব্দুল-বাহা ব্যাখায় স্পষ্ট করে বলেছেন, “…. বিবাহ সম্বন্ধে প্রশ্ন: প্রথমে তোমার কাছে মনোরম এইরূপ একজনকে অবশ্যই পছন্দ করিবে, অতঃপর বিষয়টি পিতা-মাতার সম্মতি সাপেক্ষ। তোমার পছন্দ করার পূর্বে, তাহাদের হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার নাই।” (বাহাউল্লাহ, বাব ও আব্দুল-বাহার পবিত্র লেখনাবলী হইতে সংকলিত: ১৬ নং অনুচ্ছেদ, পৃষ্ঠা ১৮৫)।
ছেলে ও মেয়ে উভয়ে উভয়কে পছন্দ করবে এবং তারা তাদের নিজ নিজ জীবিত পিতা-মাতার সম্মতির জন্য অপেক্ষা করবে। অনুরূপভাবে পিতা-মাতার উচিত ছেলে মেয়েদের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে তাতে সম্মতি প্রদান করা। সন্তান হিসেবে সম্মতির জন্য অপেক্ষা করা এবং বাবা-মা হিসেবে সম্মতি দেওয়া প্রসঙ্গে বাহাইদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান সার্বজনীন বিচারালয় তাদের দেওয়া একটি বার্তায় বলেছেন, “বাহাউল্লাহর উক্তি সঠিকভাবে সত্য যে, সকল জীবিত পিতা-মাতাদের সম্মতি বিবাহের জন্য প্রয়োজন। যা প্রত্যেক পিতামাতার উপরে একটি গভীর দায়িত্ব স্থাপন করে। যখন পিতামাতাগণ বাহাই হন, তাদের অবশ্যই, বাস্তবধর্মী হয়ে তাদের অনুমোদন রদ করা বা অনুমতি দেওয়ার কাজটি করতে হবে। তারা এ দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না, কেবল সন্তানের ইচ্ছা মুখ বুজে মেনে নেওয়া, না তাদের পূর্ব সংস্কার তাড়িত হওয়া উচিত হবে; কিন্তু তারা বাহাই বা অবাহাই যাই হোন না কেন, পিতা-মাতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণীয়, কারণ যাই হোক যে, তারা এটির অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। সন্তানদের অবশ্যই স্বীকার এবং উপলদ্ধি করা উচিত যে, একজন সম্মতি দেওয়ার কাজটি একজন পিতা-মাতার কর্তব্য। তাদের অবশ্যই হৃদয়সমূহে শ্রদ্ধা থাকতে হবে তাদের জন্য, যারা তাদের জীবন দিয়েছেন এবং যাদের সুভানুভবে সকল সময়ে অর্জন করার সুপ্রচেষ্টা করতে হবে। (From a letter dated 1 February 1968 written by the Universal House of Justice to the National Spiritual Assembly of the United States, published in Lights of Guidance, no. 1237, pp. 370-71.)
শর্ত ২: বর কর্তৃক কনেকে নির্ধারিত পরিমাণ পণ প্রদান:
বাহাই বিয়ের আরেকটি শর্ত হলো প্রচলিত যৌতুক প্রদান না করে ঈশ্বর কর্তৃক নির্ধারিত একটি পরিমাণ বর কণেকে প্রদান করবেন। কিতাব-ই-আক্বদাসের টীকা নং ৯৩ এর ২১০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে, “বাহাউল্লাহর প্রত্যাদেশের সঙ্গে সঙ্গেই অনেক প্রচলিত মতবাদ ধ্যান-ধারণা, রীতি-নীতি, প্রথা এবং প্রতিষ্ঠান-এসবের সংজ্ঞা পূনরায় নিরূপণ হয়েছে এবং নতুন অর্থ গ্রহণ করেছে। এগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে পণ। পণ এর প্রতিষ্ঠানটি বহু সংস্কৃতিতে একটি অতি প্রাচীন প্রথা এবং এটা নানা আকারে। কোন কোন দেশে কনের পিতা-মাতারা এটা বরকে প্রদান করে থাকে; আবার অনেক দেশে এটি “কনের মূল্য” নামে পরিচিত। এটা বর কনের পিতা-মাতাকে প্রদান করে থাকে। উভয় ক্ষেত্রে পরিমাণটি বেশ অধিক হয়। বাহাউল্লাহর আইন এইরূপ সব বিভিন্নতা তুলে দিয়ে পণটিকে একটি প্রতীকী আইনে পরিবর্তিত করেন, যদ্বারা বর একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ মূল্যের একটি উপহার কনেকে প্রদান করে।” এই আইনের মাধ্যমে বর্তমান সমাজের অন্যতম ব্যাধী যৌতুক প্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে। প্রচলিত যৌতুক প্রথা বিবাহের মতো পবিত্র একটি বন্ধনকে কুলষিত করেছে। যৌতুক সমাজে এতোটাই গেঁড়ে বসেছে যে যৌতুক ছাড়া মেয়ের বিয়ে দেয়া অসম্ভব কল্পনা। সমাজ যেন একে গ্রহণ করে নিয়েছে। এর প্রধান কারণ ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অধঃপতন। রাষ্ট্র কর্তৃক যৌতুক বিরোধী বিভিন্ন আইন করেও যেন একে রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিদিন খবরের কাগজে এর কারণে বিভিন্ন করুণ পরিণতি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি বন্ধ করতে দরকার নতুন জাতি, নতুন সভ্যতা, নতুন সমাজ, নতুন বিশ্ব যেখানে যৌতুকে ঘৃণা করা হয়। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকায় যার সংজ্ঞা এভাবে দেয়া হয়েছে:
‘Dowry’: The Property that a wife or a wifes family give to her husband upon marriage. যার বাংলা: যৌতুক হলো বিবাহ উপলক্ষে কন্যা বা কন্যার পরিবারের পক্ষ থেকে বরকে প্রদেয় সম্পদ। (The New Encyclopedia Britannica V. 4, P. 205)
শর্ত ৩ : পনের পরিমান:
অভিশপ্ত যৌতুক প্রথার অবসান ঘটিয়ে বাহাউল্লাহ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাঁটি স্বর্ণ বা সমপরিমাণ সম্পদ বর কর্তৃক কনেকে প্রদানের শর্ত আরোপ করেছেন। এই পরিমাণটি সর্বনিম্ন ১৯ মিশকাল খাঁটি স্বর্ণ যা সর্বোচ্চ ৯৫ মিশকাল অতিক্রম করতে পারবেনা। বর গ্রামের বাসিন্দা হলে এটি স্বর্ণের পরিবর্তে রোপ্য প্রযোজ্য হবে। এ প্রসঙ্গে মহান আব্দুল-বাহার ব্যাখ্যাটি কিতাব-ই-আক্বদাসের টীকা অধ্যায়ের ৯৫ নং এর ২১১ পৃষ্ঠায় এভাবে বর্ণিত করা হয়েছে, “আব্দুল-বাহা তাঁর ফলকলিপির একটিতে পণ এর পরিমাণ নির্ধারণের অনুবিধিগুলির কয়েকটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। নিম্নে বর্ণিত, উদ্ধৃতাংশে উল্লেখিত মাত্রা হচ্ছে ‘ওয়াহিদ’। এক ‘ওয়াহিদ, উনিশ মিশকালের সমান। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন: শহরবাসীদেরকে স্বর্ণে এবং গ্রামবাসীদেরকে অবশ্যই রৌপ্যে পরিশোধ করতে হবে। এটা বরের সম্পূর্ণ অধিকারে আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। যদি সে দরিদ্র হয় তাহলে তাকে এক ওয়াহিদ দিতে হবে; যদি সে মধ্যবিত্ত হয় তাহলে দুই ওয়াহিদ, যদি সে সচ্ছল হয় তাহলে তিন ওয়াহিদ, যদি সে সম্পদশালী হয় তাহলে চার ওয়াহিদ, এবং যদি খুব ধনী হয় তাহলে তাকে ৫ ওয়াহিদ দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে এটি বর, কনে এবং তাদের পিতামাতার মধ্যে ঐক্যমতের ব্যাপার। যে ঐক্যমত্যে পৌঁছানো যাবে, সেটা পালন করতে হবে।
শর্ত ৪: বাহাউল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত বিয়ের শ্লোক উচ্চারণ:
প্রয়োজনীয় ১ নং ও ২ নং শর্ত পূরণ হলে তারা একটি স্থানীয় আধ্যাত্মিক পরিষদের কাছে তাদের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করবে এবং বিবাহের দিন ও তারিখ জানিয়ে দিবে। সংশ্লিষ্ট স্থানীয় আধ্যাত্মিক পরিষদ নির্ধারিত দিনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার জন্য তাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি ও দুজন সাক্ষী পাঠিয়ে দেন। সাক্ষীদ্বয়ের উপস্থিতিতে প্রেরিত প্রতিনিধি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। বাহাই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় কোন বাহ্যিক আড়ম্বর নেই, বরং অতি সাধারণ একটি প্রক্রিয়া মাত্র। বাহাই বিয়ের জন্য মহান বাহাউল্লাহ কর্তৃক কিতাব-ই-আক্বদাসে অবতারিত শ্লোক বর ও কণেকে পাঠ করতে হয়। যা ইতিপূর্বের কোন ধর্মীয় গ্রন্থে বিবাহ প্রসঙ্গে বানী অবতীর্ণ হয়নি। কিতাব-ই-আক্বদাসে উল্লেখিত পবিত্র বাক্যটি হলো: “সত্য সত্যই, আমরা সকলেই অবশ্যই ঈশ্বরের ইচ্ছা মানিয়া চলিব।” (কিতাব-ই-আক্বদাস: প্রশ্ন ও উত্তর ৩, ১০৩ পৃষ্ঠা)
ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত বিবাহের বানীর তাৎপর্য :
বাহাউল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত বিবাহের সহজ সরল শ্লোকটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ, যার অর্থ অতি প্রগাঢ়পূর্ণ। এই শ্লোক উচ্চারণের সাথে সাথে বর ও কনে দুজনে পার্থিব সীমাবদ্ধতাগুলিকে অতিক্রম করে ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে। ঈশ্বরীয় ইচ্ছাগুলিকে মেনে চলার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। মানুষ হিসেবে আমাদের নিজস্ব ইচ্ছাগুলি কেবল জাগতিকতায়, নিজস্ব ভাল লাগা, না লাগায় সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু দাম্পত্য জীবন শুরু করার সময় আমরা আমাদের নিজস্ব ইচ্ছা, কামনা বাসনাকে উৎসর্গ করে ঈশ্বরীয় ইচ্ছাতে নিবিষ্ট হই। একে অপরকে সুখী করতে, সম্মান করতে, শ্রদ্ধা জানাতে, ভালবাসতে ইচ্ছা পোষণ করি। এই ইচ্ছা সম্পূর্ণভাবে জাগতিকতাকে ছাড়িয়ে আধ্যাত্মিকতায় রূপ লাভ করে। ঈশ্বরীয় ইচ্ছার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করার মাধ্যমে একসাথে পারিবারিক জীবন কাটাতে মজবুত ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করি। যার উপরে পারিবারিক জীবনের ইমারত নির্মাণ হবে। নিজের আকাঙ্খাগুলিকে বাদ দিতে না পারলে আধ্যাত্মিক ইমারত গড়ে উঠবে না। ঈশ্বরীয় ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করার মধ্যেই দম্পতির সুখ, ভবিষ্যত জীবন, পরিবার গড়ে উঠতে সহায়ক হবে। আর এ কারণেই এই পবিত্র শ্লোকটি এতো গুরুত্বপূর্ণ।
Gleanings from the Writings of Bahá’u’lláh, CLX, par. 3, pp. 383-84 এ ঈশ্বরীয় ইচ্ছা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, “ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতি নিজেদের উৎসর্গ করা তোমাদের পক্ষে শোভন হবে। যা কিছু তাঁর অনুশাসনসমূহে প্রকটিত হয়েছে তাহলো কেবল তাঁর ইচ্ছার প্রতিফলন। সুতরাং তোমাদের উৎসর্গ অবশ্যই এতোটাই সম্পূর্ণ হবে, যাতে পার্থিব ইচ্ছার সকল চিহ্ন তোমাদের হৃদয় থেকে মুছে যাবে। প্রকৃত একতার এটাই অর্থ।
শর্ত ৫: বিবাহের রেজিষ্ট্রেশন:
স্থানীয় আধ্যাত্মিক পরিষদের প্রেরিত প্রতিনিধির পরিচালনায় সাক্ষীদ্বয়ের সামনে বর ও কণে উভয়ে এই পবিত্র শ্লোক উচ্চারণ করার মাধ্যমে দুজনে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পরিগণিত হয়। এরপর স্থানীয় আধ্যাত্মিক পরিষদের বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন ফরম পূরণ করে সেটি রেজিষ্ট্রারে নথিভূক্ত করা হয়। বাহাই বিবাহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত প্রক্রিয়া। বাহাই বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন ফরম পূরণ করলে সেটি সরকারি যে কোন দপ্তরে গ্রহণযোগ্য। এজন্য বিয়ের বাহাই ফরমে নথিভুক্ত করার পর ফরমের অনুলিপি বর ও কণের কাছে এবং বাংলাদেশের জাতীয় বাহাই আধ্যাত্মিক পরিষদের অফিসে পাঠানো হয়। নব বিবাহিত দম্পতির দাম্পত্য জীবন সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে ঈশ্বরীয় আশির্বাদ কামনায় মহান বাহাউল্লাহ ও আব্দুল-বাহা অনেক সুন্দর সুন্দর প্রার্থনা প্রকাশ করেছেন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমরা ঐ প্রার্থনাগুলি পাঠ করতে পারি।
শর্ত ৬ : বিবাহের বাগদান:
ছেলে ও মেয়ের নির্বাচন এবং জীবিত পিতা-মাতাদের সম্মতি সম্পন্ন হয়ে গেলে ছেলে-মেয়ে বা তাদের পরিবার বিবাহের পরিকল্পনাটি জনসমক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করতে পারেন। অর্থাৎ তাদের বিয়ের পরিকল্পনাটি বন্ধু, সমাজ, আত্মীয়-স্বজনদের কাছে তাদের ইচ্ছা জ্ঞাত করাতে পারেন। এটি আসলে একধরণের বিবাহের আনুষ্ঠানিকতায় প্রবেশ করা। বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতিতে একে কাবিন, পানচিনি, পাকাদেখা ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতিতে একে পাটিপত্র, লগ্নপত্র বা মঙ্গলাচরণ, আশির্বাদ নামে অভিহিত করা হয়। বাগদানের ইংরেজী প্রতিশব্দ (Engagement) এনগেজমেন্ট, যার অর্থ বিয়ের চুক্তি। অনেক সময় বাগদানের পরেও ছেলে-মেয়ের মধ্যে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা অনির্দিষ্ট সময় ব্যাপী চলতে থাকে। এটি সভ্য সমাজের কাছে মোটেও ভালো উদাহরণ নয়। তাইতো বাহাউল্লাহ তার বিধানে এর সময়কাল নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিতাব-ই-আক্বদাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও সংহিতা-তে ১৪৪ পৃষ্ঠার ঝ নং অনুচ্ছেদে বিবাহের বাগদান সম্পর্কে বলা হয়েছে, “(ঝ) বিবাহের বাগদান (১) বিবাহের চুক্তিকাল অবশ্যই ৯৫ দিনের বেশি অতিক্রম করবে না।” এছাড়াও প্রশ্ন ও উত্তরসমূহ অংশের১১৬ পৃষ্ঠার ৪৩ নং প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, “. …. বিবাহের পূর্বে পঁচানব্বই দিনের পূর্বে একটি বিবাহের ঘোষণা দেওয়া অবৈধ।” আব্দুল-বাহা উল্লেখ করেছেন, “বিগত দিনে কঠিন সমস্যাসমূহ দেখা দিয়েছে, যখন বিবাহের আনুষ্ঠানিক চুক্তি এবং বিবাহের মধ্যে অনেক সময়কাল পার হয়ে গেছে।” আমাদের সবাইকে তাই এই বিধিকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো উচিত।
বাহাই বিবাহের শর্তপূরণ বাধ্যতামূলক:
উল্লেখ্য যে, বাহাইদের জন্য বিবাহ করা বাধ্যতামূলক নয়, তবে কেউ বিবাহ করতে চাইলে উপরোক্ত শর্তগুলি পূরণ করা বাধ্যতামূলক। শর্ত পূরণ হওয়ার পর একজন বাহাই বিশ্বাসী যে কোন সংস্কৃতি, রীতি, প্রথা অনুযায়ী অনুষ্ঠান করতে পারেন। এমনকি বর বা কনে কেউ একজন অন্য ধর্মের অনুসারী হলে তার ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদানে আপত্তি নেই। আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে শালীনতা বজায় রেখে গায়ে হলুদ, মেহেদী সন্ধ্যা, থুবড়া খাওয়া, বাসর সাজানো, বর যাত্রী যাওয়া, বৌভাত, গান বাজনা, নৃত্যানুষ্ঠান করতে কোন বাধা নেই। বরং এগুলি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করবে।
যাদেরকে বিয়ে করা যাবে না:
বাহাইরা যেহেতু মানবজাতির একত্বকে লালন করে, তাই একজন বাহাই বিশ্বাসী অন্য যে কোন ধর্মের বিশ্বাসীকে বিয়ে করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শর্তসমূহ পালন করা বাধ্যতামূলক। বিমাতার সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রক্তের সাথে সম্পর্কিত আত্মীয়স্বজনের সাথে বিবাহের বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এমন ক্ষেত্রে বাহাইদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান সার্বজনীন বিচারালয়ের অনুমতি গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও বয়ঃপ্রাপ্তির আগে বিবাহ চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়াকে বেআইনী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (কিতাব-ই-আক্বদাস, সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও সংহিতা, পৃষ্ঠা ১৪৪ এর গ (চ), (ছ), (জ) ও (ঝ ২))। রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়েকে নিরুৎসাহিত করার বৈজ্ঞানিক যুক্তিও রয়েছে। জীববিজ্ঞানীদের মতে দুটি নারী পুরুষের মিলন রক্ত সম্পর্কের যত দূরে হবে সেখানে জিনের বৈচিত্র্য তত বেশি ঘটবে। রক্তের সম্পর্ক যত কাছাকাছি হবে একই ধরণের জিন বহন করার সম্ভাবনা অনেক বেশি হয়। এর ফলে প্রচ্ছন্ন জন্মগত রোগ বেশি দেখা যায়। এসব শিশু মেধা ও কর্মক্ষমতায় দূর্বল প্রকৃতির হয়। হাবাগোবা, বিকলাঙ্গ, অটোজোমাল রোগসমূহের ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং পরবর্তী প্রজন্মে সেটি সঞ্চারিত হয়। অপরপক্ষে গোত্র বা রক্তসম্পর্ক বর্হিভূত বিবাহে হলে উৎপাদিত সন্তানরা দুটি আলাদা উৎস থেকে নতুন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জিন পায়, তাই বংশগত রোগগুলি বিলুপ্ত হয়ে যায়। নতুন জিনোম সৃষ্টি হওয়ার কারণে সন্তানাদি মেধাবী, কর্মক্ষম, ধীশক্তিসম্পন্ন, রোগ প্রতিরোধসম্পন্ন হয়।
একসাথে একাধিক স্বামী বা স্ত্রী নিষিদ্ধ:
বাহাই ধর্মে একসাথে একাধিক স্বামী বা স্ত্রী নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পারিবারিক শান্তি, ভালবাসা, ন্যায়পরায়ণতা এবং সাম্যতা বজার রাখতে এটি অপরিহার্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আধুনিক সভ্য সমাজের এটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এটিই সর্বজনীন রূপে বর্তমান যুগে বিকশিত হয়েছে। যদিও অতিতে বহুবিবাহের প্রচলন ছিলো। বাহাই প্রত্যাদেশের মাধ্যমে ঈশ্বর বহুবিবাহকে রহিত করে একক স্বামী বা স্ত্রীর মাধ্যমে সৃষ্ট আধুনিক পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যা ধীরে ধীরে অন্য সমাজ, জাতী, ধর্মীয় সম্প্রদায় গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকে দ্বিতীয় বিয়ের খোঁড়া যুক্তি প্রদর্শন করে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করে থাকেন। বাহাই বিধানে এ ধরণের কোন যুক্তির সুযোগ রাখা হয়নি। বহু বিবাহ মানব ইতিহাসের অতি প্রাচীন এক প্রথা, যেটি বিভিন্ন ধর্মেও স্বীকৃত ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে যীশু খ্রীষ্ট বহু বিবাহকে নিষেধ করেননি এবং তিনি তালাক প্রথাকে তুলে দিয়েছিলেন। মুহাম্মদ (সঃ) পুরুষদের একসাথে চার স্ত্রী রাখার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের শর্তযুক্ত নিয়ম করে দেন। কিন্তু মুহাম্মদরে পরে বিধানের আইনসঙ্গত ব্যাখ্যাকারী না থাকার কারণে তাঁর অনুসারীগণ এটি থেকে দূরে সরে যায় এবং একাধিক বিয়েতে প্রলুদ্ধ হয়। বাহাই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহান বাহাউল্লাহ আবহমান কালের প্রচলিত বহুবিবাহের প্রথাটিকে বিজ্ঞতা ও প্রগতিশীল নীতিমালার মাধ্যমে জনগণের কাছে উপস্থাপন করেন। তিনি তাঁর লেখনাবলীর নির্ভুল ব্যাখাদাতা হিসেবে আব্দুল-বাহাকে নিয়োগ করে যান। আব্দুল-বাহা পরবর্তীকালে বিবাহ সংক্রান্ত মহান বাহাউল্লাহর দুই স্ত্রীর শর্তযুক্ত নিয়মের বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করেন। কিতাব-ই-আক্বদাসের ৮৯ নং টীকায় বিবৃত হয়েছে, “যদিও কিতাব-ই-আক্বদাস এর মূল ভাষ্য দুই বিবাহের অনুমতি দান করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, বাহাউল্লাহ উপদেশ দিচ্ছেন যে, সুখ ও পরিতৃপ্তি এক বিবাহ থেকে উদ্ভূত হয়।………..বাহাই লিখনাবলীর অধিকারপ্রাপ্ত ব্যাখ্যাকারী আব্দুল-বাহা দৃঢ়ভাবে বলেন যে, আক্বদাস এর মূল পাঠে কার্যতঃ এক বিবাহেরই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিম্নলিখিত বিষয়সহ, তিনি এই মূল বিষয়বস্তুটিকে কয়েকটি ফলকলিপিতে বিশদ করেন: তোমরা জানিয়া রাখো যে, ঈশ্বরের আইনে বহুবিবাহের অনুমতি দেওয়া হয় নাই, কারণ এক স্ত্রীতে পরিতৃপ্ত থাকা সুষ্পষ্টভাবে শর্তযুক্ত হইয়াছে। দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ, দুইটি স্ত্রীর মধ্যে সর্বাবস্থায় সমতা ও ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখিবার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু দুই স্ত্রীর প্রতি সমতা ও ন্যায়পরায়ণতা পালন করা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। দ্বি-বিবাহের বিষয়টি যে একটি অসম্ভব শর্তের উপর নির্ভরশীল করা হইয়াছে তাহা ইহার সন্দেহাতীত নিষেধের সুস্পষ্ট প্রমান। এমতাবস্থায় একজন লোকের পক্ষে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করা অনুমোদনীয় নহে।”
বিবাহ বিচ্ছেদ:
বিবাহের বন্ধন পবিত্রতম। বিশ্বের সকল ধর্মের বিবাহের মূল উদ্দেশ্য দম্পতির একসঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা। বিয়ে কেবলমাত্র যৌনতার আবেগ নয়, এর সাথে রয়েছে ঈশ্বরীয় ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো। তাইতো বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালবাসা, আবেগ, সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ ও বিশ্বাসের বিষয়গুলি সংশ্লিষ্ট। বাহাই প্রত্যাদেশে এজন্য বিয়ের আগে ছেলে ও মেয়েকে জানার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বিবাহ বিচ্ছেদকে এড়ানোর জন্যই এ ব্যবস্থা। পরস্পরকে জানাজানির সময় ছেলে ও মেয়ের কোন কিছু গোপন করা উচিত নয় যা পরে জানাজানি হলে সমস্যা হতে পারে। গোপন বিষয় প্রকাশিত হলে প্রতারণার বিষয়টি মাথা চাড়া দেয়। এভাবেই বিচ্ছেদের সুত্রপাত হয়। বিবাহকে দাম্পত্য জীবনের চারাগাছ হিসেবে ধরা হয়, যার বিকাশের জন্য প্রতিনিয়ত পরিচর্চা প্রয়োজন। সঠিক যত্নে এই কচি চারাগাছ একদিন বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়ে পরিবার, সমাজ তখা মানবজাতিকে সুমিষ্ট ফল প্রদান করতে থাকে। দূর্ভাগ্যবশতঃ বর্তমান কালে বিবাহ বিচ্ছেদ অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি বিষয় হয়ে উঠছে। বিবাহ বিচ্ছেদ যেন না ঘটে সেজন্যই বাহাই বিয়ের শর্তাবলী কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য বলা হয়েছে।
বিয়ের সময় কেউ এই শর্তগুলির কোন একটিকে অবহেলা করলে বিচ্ছেদের মতো সমস্যাগুলি সামনে চলে আসে। বাহাই ধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদকে শর্তযুক্তভাবে অনুমোদন করা হলেও এটিকে কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়েছে। কিতাব-ই-আক্বদাসের ৬৮ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, “স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিরক্তি ও বিদ্বেষের উদ্ভব হইলে, স্বামী তাহাকে তালাক না দিয়া পূর্ণ এক বৎসর যাবৎ ধৈর্য সহকারে প্রতীক্ষায় থাকিবে, যাহাতে, হয়তো তাহাদের মধ্যে অনুরাগের সৌরভ পুনরুজ্জীবিত হইতে পারে। যদি এই নির্দিষ্ট সময় পূর্ণ হইবার পরেও তাহাদের ভালবাসা ফিরিয়া না আসে, তাহা হইলে বিবাহবিচ্ছেদ অনমোদনীয়।” স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদের অবস্থা সৃষ্টি হলে তৎক্ষনাৎ সেটি কার্যকর করার ব্যবস্থা নাই। তাদের অবশ্যই পুরো একবছর কাল অপেক্ষা করতে হবে এবং পরস্পরের মেলামেশা থেকে দূরে থাকতে হবে। একে অপেক্ষাকালীন সময় বলে। অপেক্ষাকালীন সময়ে বাহাই পরিষদ তাদের ভুলবোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে পূণরায় মিলনের প্রচেষ্টা চালাবে। তাদের মধ্যে মিলনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে অপেক্ষাকালীন সময়ের পর তা কার্যকর বলে বিবেচিত হবে ও সেটি নথিভূক্ত করা হবে। অপেক্ষাকালীন সময় প্রসঙ্গে কিতাব-ই- আক্বদাসের প্রশ্ন ও উত্তরসমূহ এর ৯৮ নং এ বলা হয়েছে, “…….একে অন্য হইতে আলাদা থাকাকালীন এক বৎসর শেষ না হওয়া পর্যন্ত, দুই জন বা ততোধিক লোককে সাক্ষীরূপে অবশ্যই অবগত থাকিতে হইবে। যদি শেষ পযর্ন্ত, পুনর্মিলন না ঘটে তাহা হইলে বিবাহবিচ্ছেদ কার্যর্কর হইবে।… “বিবাহবিচ্ছেদ নথিভুক্ত করার দায়িত্বটি মূলতঃ বাহাই পরিষদের উপরেই বর্তায়। কিতাব-ই-আক্বদাসের প্রশ্ন ও উত্তরসমূহ ৯৮ এ বলা হয়েছে, “…… এই বিষয় বিচারালয়ের অছিদের দ্বারা নিযুক্ত শহরের ধর্মীয় বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা কর্তৃক নিবন্ধন দপ্তরে অবশ্যই নথিভুক্ত করিতে হইবে। এই কার্যপ্রণালীর পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য, যেন যাহারা বোধশক্তিসম্পন্ন হৃদয়ের অধিকারী, তাহারা দুঃখভারাক্রান্ত না হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় পরিষদ, বন্ধু ও শুভানুধায়ীদের প্রচেষ্টায় এই অপেক্ষাকালীস সময়ের মধ্যেই স্বামী ও স্ত্রী মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে এবং পূণরায় তারা একত্রিত হয়ে সুখি জীবন-যাপন করে। একটি দম্পতির মধ্যে মতভেদ হলে স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ অথবা উভয়েই বিবাহ বিচ্ছেদ দাবী করতে পারেন। এ বিষয়ে কিতাব-ই-আক্বদাসের প্রশ্ন ও উত্তরসমূহ এর ১০০ নং এ বাহাই ধর্মের অভিভাবক শৌগী এফেন্দীর উদ্ধৃতিটি তুলে ধরা হয়েছে, “শৌগী এফেন্দী দৃঢ়রূপে বলেন যে, ‘স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করার সমান অধিকার রয়েছে।’ যখনই যে কোন সঙ্গী ‘এইরূপ করা সম্পূর্ণরূপে অপরিহার্য মনে করিল’ অপেক্ষাকালীন সময় পার হয়ে গেলেও যখন তাদের মধ্যে ভালোবাসা পুনরুজ্জীবিত হয়না তখন তাদের বিচ্ছেদ ঘটে যায়। কিন্তু বিচ্ছেদের পরে যদি কোন সময় আবারো তাদের মধ্যে সদ্ভাব ফিরে আসে এবং তারা পরস্পর একত্রে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে বিবাহের সকল শর্ত পূরণ করে তারা পূণরায় বিয়ে করতে পারবেন। এ বিষয়ে কিতাব-ই-আক্বদাসের ৬৮ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, “. …… যে স্বামী তাহার স্ত্রীকে তালাক দিয়াছে, সে প্রতি অতিক্রান্তের মাসের পরে, যদি পারস্পরিক অনুরাগ ও সম্মতি থাকে, তাহাকে পুনরায় বিবাহ করিতে পারে যে পযর্ন্ত না সে অন্য স্বামী গ্রহণ করিয়াছে। যদি সে পুনরায় বিবাহ করিয়া থাকে, তাহা হইলে এই পরবর্তী বিবাহ দ্বারা তালাক বহাল থাকিবে এবং বিষয়টি চূড়ান্ত নিষ্পত্তিরূপে গণ্য হইবে যদি না তাহার অবস্থা সুস্পষ্টরূপে পরিবর্তিত হয়। এইরূপ-ই আদেশ, এই মহিমান্বিত ফলকলিপিতে তাঁহারই মহত্ত্ব দ্বারা লিখিত হইয়াছে, যিনি সুষমার প্রাভাতিক স্থল।” বিবাহবিচ্ছেদের পর পূণরায় একত্রিত হতে চাইলে উভয় পক্ষকে রাজি হতে হবে। কিতাব-ই-আক্বদাস এর প্রশ্ন ও উত্তরসমূহ এর ৩৮ নং এটি স্পষ্ট করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “কিতাব-ই-আক্বদাস-এ প্রকাশিত আদেশ অনুসারে উভয় পক্ষকেই রাজি হইতে হইবে। উভয় পক্ষ ইচ্ছুক না হইলে পুনর্মিলন ঘটিতে পারিবে না। ‘‘যাই ঘটুক না কেন, চেষ্টা করতে হবে যেন বিবাহবিচ্ছেদ না ঘটে। অভিভাবক শৌগী এফেন্দী বলেছেন, “বিশ্বাসীগণকে অত্যন্ত কঠোরভাবে বিবাহবিচ্ছেদকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত, এবং কেবলমাত্র বিরল ও জরুরী পরিস্থিতিসমূহের শেষ অবস্থা পর্যন্ত। আধুনিক সমাজ বিবাহের পবিত্র সম্পর্কের প্রতি অপরাধমূলক মনোভাবে উদাসীন, এবং বিশ্বাসীদের অবশ্যই এই প্রবণতা উদ্যোগী হয়ে সংগ্রাম করতে হবে।”
From a letter dated 5 January 1948, written on behalf of Shoghi Effendi to an individual believer, in “Extracts from the Bahá’í Teachings Discouraging Divorce”, published in The Compilation of Compilations, vol. 1, no. 546, p. 243; also in “Preserving Bahá’í Marriages”, published in The Compilation of Compilations, vol. 2, no. 2328, p. 450.
অপেক্ষাকালীন সময়ের ভরণপোষণ:
চুড়ান্তভাবে বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার আগে পুরো একটি বছর স্বামী-স্ত্রী পৃথক অবস্থানে থেকে অপেক্ষাকালীন সময়টি অতিবাহিত করে। এই অপেক্ষাকালীন সময়ে ভরণ-পোষণের বিষয়টি জড়িত। বিবাহের পর ভরণপোষণ নির্বাহ করা স্বামীর দায়িত্ব এবং ভরণপোষণ পাওয়া স্ত্রীর অধিকার। স্ত্রীর এই অধিকার এবং স্বামীর দায়িত্বটি চুড়ান্তভাবে বিচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকে। অর্থাৎ অপেক্ষাকালীন সময়ে স্বামীকে স্ত্রীর ভরণপোষণ নির্বাহ করতে হবে। আসলে অপেক্ষাকালীন সময়টি বিবাহ বিচ্ছেদ নয়, বিচ্ছেদের প্রস্তুতি পর্ব। তবে অপেক্ষার একবছর পার হলে সেটি শেষ হয়ে যাবে। স্ত্রীর ব্যভীচার এর মতো কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে এক্ষেত্রে অপেক্ষাকালীন সময়ে স্বামীকে ভরণপোষণ বহন করতে হবে না। যেমনটি কিতাব-ই- আক্বদাসের ৭০ নং শ্লোকে বর্ণিত হয়েছে, “কোন নারী প্রমানিত ব্যভিচার কর্মের ফলে তালাকপ্রাপ্তা হইলে, সে তাহার অপেক্ষাকালীন কোন ভরণ-পোষণ পাইবে না…..। ” এ সম্পর্কে কিতাব-ই-আক্বদাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও সংহিতার ৪ এর গ অনুচ্ছেদ পারিবারিক আইনসমূহ এর ২ নং সেকশনের বিবাহ বিচ্ছেদ এর ঘ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “স্বামীর অবিশ্বস্ততার কারণে যে স্ত্রী তালাকপ্রাপ্তা হবে, সে অপেক্ষাকালীন সময়ের খরচের অর্থ পাওয়ার অধিকার হারাবে।”
উপসংহার:
বাহাই বিবাহ মানব ঐক্য ও শান্তির প্রতীক। এটি একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে মানব সমাজের গঠন সুসম্পূর্ণ হবে। বাহাই বিবাহের শর্ত, প্রক্রিয়া, নিয়মাবলী কোন বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ের জন্য নয় বরং এই প্রক্রিয়া ও নীতি সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য। একে পরিপুষ্টি প্রদান করে আমাদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। বাহাই একটি আদর্শ যার মাধ্যমে নতুন সভ্যতা এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে। বাহাই হতে হলে যেমন সৃষ্টিকর্তার একত্ব, মানবজাতির একত্ব ও ধর্মের একত্বকে স্বীকার করতে হয়, তেমনিভাবে বাহাউল্লাহর শিক্ষানুসারে জীবন-যাপনও করতে হয়। বাহাই বিবাহ বাহাউল্লাহর শিক্ষাসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি তাই এটিকে অবহেলা করার কোন সুযোগ আমাদের নেই।