বাহা’ই উত্তরাধিকার আইন

বাহা’উল্লাহর শিক্ষা তার পরিধিতে সার্বজনীন: তার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো একতা যা ঈশ্বরের একত্বে, তাঁর বার্তাবাহকদের এবং মানবতার একতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বাহা’উল্লাহ দিকনির্দেশনা ও আইনকানুনের এমন একটি সংহিতা প্রদান করেছেন যা ঐশী ও আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা, সহায়তা এবং করুনার জন্য মানুষের আস্থাকে প্রকাশিত করে।

বাহাইদের জন্য মানবতার পরিত্রাণ ঐশী দিকনির্দেশনার মধ্যেই নিহিত। বাহা’উল্লাহ তাঁর ধর্মের নিয়ম-কানুন পরম পবিত্র গ্রন্থ কিতাব ই আক্বদাস-এ প্রকাশিত করেছেন।

বাহাইরা সেই গ্রন্থে প্রকাশিত আইনগুলোকে তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে বাধা স্বরুপ দেখে না বরঞ্চ ঐ নিয়মগুলোকে, এই সকল আদেশাবলীকে মানবতার জন্য তাঁর করুণার নিদর্শন রুপে দেখে।

বাহাইরা বিশ্বাস করে যে সৃষ্টিকর্তা তাঁর বার্তাবাহকদের মাধ্যমে যে সকল নিয়ম-কানুন, বিধিবিধান মানবজাতিকে দেন তা সমাজে শান্তি, একতা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য।

পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর মতোই বাহাই ধর্মেও প্রার্থনা ও উপাসনা, বিবাহ ও পারিবারিক জীবন, জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে শিক্ষার ছাড়াও নারী পুরুষের সমান অধিকার, শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষা, প্রত্যেক ব্যাক্তির জন্য ইউল লেখার আদেশ ও সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকারের আইনের মতো বিধানও দিয়েছে।

সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলা বাংলাদেশের আদালতগুলোকে প্রায় অচল করে ফেলেছে। নাগরিকরা, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী দশকের পর দশক ব্যায়বহুল আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের সর্বস্ব হারাচ্ছে। ১১ আগষ্ট ২০১৭ এ প্রকাশিত পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট এন্ড হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লিগ্যাল এ্যাডস সার্ভিসেস এর একটি সমিক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবার জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধে জড়িয়ে আছে। এই সমিক্ষায় দেখা যায় যে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ২০,০০,০০০ এর অধিক সম্পত্তি বিষয়ক মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

এই বিষয়ে অন্যতম বিশেষজ্ঞ ডঃ আশিকুর রহমান বলেন যে এই জাতীয় বিরোধের প্রধান কারণ হলো এমন কোন ইউলের অনুপস্থিতি যেখানে সুস্পষ্ট ভাবে লেখা থাকবে যে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি কিভাবে ও কাদের মধ্যে ভাগ করা হবে। এই সমিক্ষা থেকে আমরা এটাও জানতে পারি যে ইউলের অনুপস্থিতির কারনে একটি গড়পড়তা পরিবারকে প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা তাদের মকাদ্দেমা পরিচালনার জন্য ব্যায় করতে হচ্ছে।

উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদ পরিবারে দ্বন্দ, সহিংসতা, ভাঙ্গন এমন‌কি হত্যার মত গুরতর অপরাধকেও জন্ম দিচ্ছে। এর আর একটি নেতিবাচক দিক যা এই সমিক্ষায় দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে আদালত ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে উৎকোচ গ্রহনের মত অনৈতিক এবং আইন বিরোধী প্রবনতাকে উস্কে দেওয়া।

এই সব কিছুর পিছনে রয়েছে কোন‌ ব্যাক্তির একটি ইউল না রেখে যাওয়া।

বাহাই ধর্মের প্রবর্তক বাহা’উল্লাহ ইউল লেখাকে সুস্পষ্ট রূপে ধর্মের একটি বিধান‌ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং প্রত্যেক বাহাইয়ের জন্য ইউল লেখাকে বাধ্যাতামূলক কর্তব্য রুপে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাহাই ধর্মের পবিত্রতম গ্রন্থ কিতাব ই আক্বদাস-এর ১০৯ অনুচ্ছেদে তিনি আদেশ দিয়েছেন “একটি ইষ্টিপত্র লিপিবদ্ধ করিতে প্রত্যেকের প্রতি আদেশ দেওয়া হইয়াছে।” এই বিধানকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। একটি ইউল লেখা কেবল একটি আধ্যাত্মিক দায়িত্ব ও “এই মহত্তম প্রত্যাদেশের অন্যতম বাধ্যতামূলক বিধান”ই নয় বরং তা যে ব্যাক্তি ইউল লেখছে তাকে তার সম্পত্তি, যার মধ্যে তার বাসস্থানও অন্তর্ভুক্ত, কী ভাবে বন্টন হবে সেই ক্ষেত্রে সম্পুর্ন স্বাধিনতা প্রদান করে, এই বিষয়টি মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিবাদ ও আইনি জটিলতা এড়াতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।

যদিও একজন বাহাই ধর্মাবলম্বী তার উইলে কী লেখবে তা তার উপরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু কিছু কিছু বিষয় বাহাই উইলকে বিশিষ্টতা প্রদান করে, যেমন তাতে সেই ব্যাক্তির বাহা’উল্লাহর ধর্মের প্রতি বিশ্বাসের ঘোষণা, বাহাই নিয়মে তার শেষকৃত্যের ইচ্ছা লিপিবদ্ধ থাকে।

বাহাই আইনে কোন ব্যাক্তিকে তার সম্পত্তি তার ইচ্ছা মতো বন্টন করার সম্পুর্ন অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যদি কোন ব্যাক্তি ইউল না রেখে মৃত্যু বরন করে তখন তার সম্পত্তির ভাগ কিতাব ই আক্বদাস-এর সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী করা হয়। এই নিয়মের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে তাদের জীবদ্দশায় ইউল লেখে যেতে উৎসাহিত করা।

কিতাব ই আক্বদাস-এ প্রদত্ত আইন ব্যাক্তিকে তার সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে সম্পুর্ন স্বাধিনতা প্রদান করে, তাই বাহা’উল্লাহ প্রত্যেক বাহাইয়ের প্রতি ইউল লেখা বাধ্যতামূলক করেছেন।

যদি কোন ব্যাক্তি ইউল না রেখে মারা যায় তাহলে প্রথমে তার সমস্ত ঋণ (যদি থেকে থাকে) শোধ করতে হবে, তার পরে তার শেষকৃত্যের ব্যায় তার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে প্রদান করা হবে। তার পরে অবশিষ্ট সম্পদ বাহাই নিয়মে নির্দিষ্ট ক্রম অনুযায়ী উত্তরাধিকারিদের মধ্যে বন্টন হবে।

ইউলের অনুপস্থিতিতে কিতাব ই আক্বদাস-এর নিয়ম অনুযায়ী সম্পত্তির ৪২ ভাগ করা হয় এবং তা উত্তরাধিকারিদের সাতটি শ্রেনির মধ্যে ভাগ করা হয়। এই শ্রেনিগুলো হলো: সন্তান, স্বামী/স্ত্রী, পিতা, মাতা, ভাই, বোন এবং শিক্ষক। তাদের মধ্যে সম্পত্তি বন্টনের হার ভিন্ন ভিন্ন। সন্তানরা পায় নয় ভাগ, স্বামী বা স্ত্রী আট ভাগ, পিতা সাত, মাতা ছয়, ভাই পাঁচ, বোন চার, এবং শিক্ষক তিন ভাগ পাবে।

একই অবস্থায়, অর্থাৎ ইউল না রেখে যাওয়ার ক্ষেত্রে, যদি কোন শ্রেনির উত্তরাধিকার না থাকে তাহলে তার বা তাদের অংশ স্থানীয় আধ্যাত্মাক পরিষদ (গ্রাম বা শহরের বাহাই পরিচালনা পরিষদ) পাবে। যা তারা কল্যানমূলক কাজে ব্যায় করবে।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বাহা’উল্লাহর আইনে সম্পত্তি বন্টনের যে শুধু একজন বাহাইয়ের অধিকারই নয় তাকে তার আধ্যাত্মিক দায়িত্বে উন্নিত করা হয়েছে। বাহা’উল্লাহ বলেছেন যে সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতে ন্যায়পরায়নতা সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু, তাই একজন বাহাই ন্যায়বিচারের আলোকে এবং তার বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী তার সম্পদ বন্টনের সম্পুর্ন অধিকার রাখে। অনেকেই মনে করেন যে সম্পদের নির্দিষ্ট ছকে বন্টনের মাধ্যমে সম্পদের অল্প কয়েক জনের হাতে সিমা বদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা এড়ানো যায়, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে এই পদ্ধতিতে সম্পদ বিশেষ করে কৃষি জমি ছোট্ট ছোট্ট অর্থনৈতিক ভাবে অলাভজনক খন্ডে ভাগ হয়ে যায়। তাই এখন বিশ্বের প্রায় সকল সমাজেই বাহাই নিয়মের মত আইন বলবৎ আছে।

(বাংলাদেশ ল টাইমস কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন ধর্মে উত্তরাধিকার আইন বিষয়ক আলোচনা সভায় বাহাই প্রতিনিধির বক্তব্যের ভিত্তিতে লিখিত)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top