নক্ষত্রের অভিযাত্রী: ‌প্রথম বাহাই নভোচারীর গল্প

সময়:১৯৫০এর দশকের শেষের দিক

স্থান: দক্ষিণ কেরোলাইনার একটি ছোট শহরের সরকারি গ্রন্থাগার

নয় বছরের একটি ছেলে:

ম্যাম, আমি এই বই পড়ার জন্য নিতে চাই

লাইব্রেরীয়ান:

তুমি এখানে কী করছ? জানো না যে বই শুধু শ্বেতাঙ্গদেরকে দেওয়া হয়? এখনই এখান থেকে চলে যাও! না হলে পুলিশ ডাকবো।

ছেলে: (সরল মনে) ওহ, আচ্ছা, পুলিশ আসলে বই দিবেন। অপেক্ষা করি তাহলে।

এটা বলে ছেলেটা লাফ দিয়ে লাইব্রেরীয়ানের ডেস্কে উঠে বসে গেল।

মহিলা শুধু পুলিশই ডাকলেন না, বরং তিনি সেই শিশুর মাকেও ডেকে পাঠালেন।

শিশুর মা এক মাইল দূরে তার বাসা থেকে প্রার্থনা করতে করতে আসলো ‘হে ঈশ্বর পুলিশ যেন  আমার অবুঝ বাচ্চাকে জেলে না পাঠিয়ে দেয়’।

ম্যাকনায়ার সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও

কেননা সে সময় আমেরিকায় সেগ্রিগেশন বা সাদা-কালো মানুষকে পৃথক রাখার নীতি অত্যন্ত কড়াকড়ি ভাবে প্রয়োগ করা হতো। জিম ক্রো আইন নামে পরিচিত এই আইন অনুযায়ী সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও দুই বর্ণের ছাত্ররা একসাথে পড়তে পারত না এবং রেস্তোরাঁগুলোতে একসাথে খাওয়া নিষেধ ছিল।

পুলিশ লাইব্রেরীতে পৌছাল।

রোনাল্ড ইরওয়িন ম্যাকনায়ার
মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের ডাক টিকেটে রোনাল্ড ইরওয়িন ম্যাকনায়ার

দশাসই দুই জন অফিসার এসে মহিলাকে বলল, কী সমস্যা হয়েছে? কে ঝামেলা করছে?

লাইব্রেরীয়ান ছোট সেই ছেলের দিকে ইশারা করে বললো “এই ছেলে”।

তখন তারা প্রথম বারের মত ছেলের দিকে খেয়াল করল।

কী করেছে সে?

বই নিতে চায় ।

পুলিশদের একটু দয়া হলো, এক জন বলল ‘দিয়েই দেন না’।

এতক্ষনে ছেলের মাও চলে আসছে। পুলিশের কথা শুনে সেও একটু সাহস পেলো। আস্তে করে লাইব্রেরীয়ানকে বলল, জী, দিয়ে দেন না, আমার ছেলে বইয়ের খুব যত্ন নেয়।

লাইব্রেরীয়ানকে অনীচ্ছা সত্তেও ছেলেকে বই দিতে হলো।

ছেলেটির নাম রোনাল্ড ইরওয়িন ম্যাকনায়ার, যাকে সবাই রনি বলে ডাকে ।  এই ঘটনাটি ঘটে ১৯৫৯ সালে। তখনো আমেরিকায়, বিশেষ করে তার দক্ষিন‌ অঙ্গরাজ্যগুলোতে, বর্ণবাদ শক্ত ভাবে জেঁকে বসে আছে। পাবলিক বাসে কোন শ্বেতাঙ্গ উঠলে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে তাদের জন্য সিট ছেড়ে দিতে হয়, পার্কে এক বেঞ্চে বসাও আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ ছিল।

এই যখন অবস্থা, তখন ১২ অক্টোবর ১৯৫০এ দক্ষিণ কেরোলাইনার শহর লেক সিটিতে রোনাল্ডের জন্ম। তার বাবা একজন মটর মেকেনিক এবং মা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলো।

অনান্য কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের মত তারাও মূল শহর থেকে এক মাইল দূরে একটি বস্তিতে থাকতেন, যেখানে না ছিল বিদ্যুৎ, না ছিল কলের পানির ব্যবস্থা। বৃষ্টি হলে তাদের ছাদের ফুটো দিয়ে পানি পড়ত।

এমন প্রতিকুল পরিবেশেও তার পড়া ও জানার প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। রনি তিন বছর বয়েসেই লেখতে ও পড়তে শিখে নিল। তার এই আগ্রহই কাউকে না জানিয়ে এক মাইল দূরে লাইব্রেরীতে নিয়ে গিয়েছিল। সে বিশেষ করে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কি ভাবে কাজ করে তা জানতে চাইতো, তাই স্কুলের বন্ধুরা তাকে গিজমো* বলে ডাকতো।

অক্টোবর ১৯৫৭এ যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক মহাশুন্যে নিক্ষেপ করে, তখন সারা বিশ্বে একটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় এবং ছোট রনিও তাতে প্রভাবিত হয়, তারই কয়েকটি বছর পরে টেলিভিশনে একটি বিজ্ঞান-কল্পকাহিনী ভিত্তিক সিরিয়াল ষ্টারট্রেক শুরু হয়। রনির জন্য এই সিরিজের মূল আকর্ষণ ছিল এতে কৃষ্ণাঙ্গ নভোচারীদের চরিত্র! যে দেশে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যাক্তি বাসে সম্মানের সাথে বসতে পারে না সে দেশে স্পেসশিপে তার মত একজন কৃষ্ণাঙ্গ নভোচারী থাকবে তা ছিল অভাবনীয়। কিন্তু রনি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে সে নভোচারী হবে! তার বড় ভাই তাকে  বুঝাল এটা বিজ্ঞান-কল্প কাহিনী, কিন্তু রনির উত্তর ছিল এটা বিজ্ঞান-সম্ভাবনা কাহিনীও তো হতে পারে!

রনি ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে আমেরিকার চরম বর্ণবাদ ও তার পরিবারের দারিদ্র্য সত্তেও তার লেখা পড়া চালিয়ে যায় এবং ২৬ বছর বয়সে বিশ্ব বিখ্যাত মেসাচুটাস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এম,আই, টি) থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে ডক্টরেট করে এবং শিঘ্রই লেজার পদার্থ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একজন বিশেষাজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

সে শুধু একাডেমিক বিষয়ই পারদর্শী ছিল না। ১৯৭৬ সালে সে কারাতেতে স্বর্ন পদক পায় এবং ৫ম ডিগ্রির ব্ল্যাক বেল্ট অর্জন করে।

তা ছাড়া রোনাল্ড সঙ্গিতেও সমান দক্ষতা রাখতো। সে একজন দক্ষ সাক্সোফোনবাদক এবং জাজ সঙ্গীত প্রেমিক ছিলো।

১৯৭৮ সালে নভোচারী হওয়ার তার “স্বপ্ন”পুর্ন হওয়ার সাল ছিল, যখন ১০,০০০এর অধিক প্রার্থীদের মধ্য থেকে ৩৫ জনকে প্রাথমিক ভাবে বেছে নেওয়া হয় এবং সেই তালিকায় তার নামও অন্তর্ভুক্ত ছিল। চুড়ান্ত ভাবে রোনাল্ড ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ সালে স্পেসশিপ চ্যালেঞ্জারে মিশন বিশেষজ্ঞ হিসেবে মহাশূন্যে যাত্রা করে।

রোনাল্ড ইরওয়িন ম্যাকনায়ার হচ্ছে দ্বিতীয় কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম বাহাই মহাকাশচারী।

রনি খুব অল্প বয়সে বাহাই শিক্ষার সংস্পর্শে আসে, তার এলাকায় দুইজন বাহাই মহিলা আধ্যাত্মিক শিক্ষার ক্লাস পরিচালনা করতেন।  সেই ক্লাসের মাধ্যমেই সে বাহাই বাণী পায়।

১৯৮৬এ দ্বিতীয় বারের মত সে মহাকাশ যাত্রার জন্য নির্বাচিত হয়।  কিন্তু ২৮ জানুয়ারিতে চ্যালেঞ্জার স্পেস শাটল নিক্ষেপের মাত্র ৭৩ সেকেন্ড পরে আতলান্তিক মহানগরের ৯ মাইল উপরে বিস্ফোরিত হয় এবং ম্যাকনায়ার সহ ৭ জন নভোচারী মৃত্যু বরন করেন। এই ভাবে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ম্যাকনায়ার এই জগত থেকে বিদায় নেয়।

সেই অন্তিম মহাকাশ যাত্রার সময় বাহাই প্রার্থনা বই তার সঙ্গে ছিল এবং সে দুর্ঘটনার আগের রাতেও অন্য ৬ জন সহযাত্রীদের জন্য তার বাসায় একটি বাহাই আলোচনা সভার আয়োজন করে ছিল।

আমেরিকার সরকার তাকে কনগ্রেশনাল স্পেস মেডেল অফ অনারে ভূষিত করে এবং মার্কিন শিক্ষা বিভাগ তার নামে উচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে।

তার নিজের মাতৃশিক্ষায়তন এম,আই,টি সহ সারা আমেরিকায় বিভিন্ন স্থানে তার নামে রাস্তা, ভবন ও পার্কের নামকরন করা হয়েছে।

চাঁদের একটি ক্রেটারের নামও তার নামে ম্যাকনায়ার রাখা হয়।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো যে, যে গ্রান্থাগারে ছোট রনি ও তার মাকে অপমানিত হতে হয়েছিল সেই পাবলিক লাইব্রেরীর নাম এখন রোনাল্ড ম্যাকনায়ার লাইফ হিসটোরি সেন্টার।

*গিজমো : যে ছেলে বা মেয়ে যন্ত্রপাতি প্রতি খুব আকৃষ্ট ও তা ভাল বোঝে তাকে অন্য বাচ্চারা এই নামে ডাকে। মূলত এটি একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ভিত্তিক চলচ্চিত্রের একটি চরিত্রের নাম ছিল।

লেখক: মাহমুদুল হক, শিক্ষক, অনুবাদক ও লেখক

বিশেষ দ্রষ্টব্য: ব্লগে প্রকাশিত বিষয়বস্তু ব্যাক্তিগত মতামতকে প্রতিফলিত করে, প্রামানিক বাহাই দৃষ্টিকোন নয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top