এক ঐক্যবদ্ধ বিশ্বের পথে

(ঐক্যবদ্ধ বিশ্বের পথ কণ্টকাকীর্ণ ও দুর্গম, কিন্তু এই যাত্রা অসীম প্রশান্তিরও বাহক)

আমরা আজকে এমন এক দ্রুত পরিবর্তনশীল  হিংসায় উন্মত্ত এবং নিত্য নিঠুর দ্বন্দে ক্লান্ত যুগে বাস করছি, যে প্রায়শই আমাদের ধারণা করা সম্ভব হয় না যে আমরা সবাই কোন পথে চলছি। বর্তমান বিশ্বের সমস্ত বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি এবং ভাঙন দেখতে দেখতে আমাদের সকলেরই মনে হয় এক ধরণের নতুন সূচনা প্রয়োজন। এখানেই বাহা’ই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বাহাউল্লাহ-এর শিক্ষা, আশা এবং আধ্যাত্মিক নবজাগরণের এক সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করে। তিনি বলেছেন, “বর্তমান সভ্যতার পতনের ঘূর্ণির গভীরে একটি নতুন জীবন গভীরভাবে আলোড়িত হচ্ছে। যখন অধিকাংশ মানুষ বিভ্রান্ত ও নিরাশাগ্রস্ত, এবং ফলস্বরূপ নিয়তির নিকট সমর্পিত, ঠিক সেই সময়ে, গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয়, যে প্রতিষ্ঠানটির রূপরেখা স্বয়ং বাহাউল্লাহ স্থির করেছিলেন, তার দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং পরিচালিত বাহা’ই সম্প্রদায়, ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতির বাস্তবতা বুঝে এবং  বিশ্ববাসীর দুঃখজনক অবস্থার কারণগুলি চিহ্নিত করে, বাহা’ই সম্প্রদায় শুধুমাত্র ম্যাক্রো-স্তরের সমস্যাগুলিই নয়, ক্ষুদ্র-স্তরের চ্যালেঞ্জগুলিকেও সমাধান করছে। আমি কয়েকটিসমস্যার তালিকা করি: প্রথমতঃ এমন একটি বিশ্ব যেখানে রাজনৈতিক নৈরাজ্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। জাতীয়তাবাদ এবং অরাজকতা এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে প্রতিটি জাতি কেবল নিজের সম্পর্কে চিন্তা করে। দ্বিতীয়তঃ এমন একটি বিশ্ব যা অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ঐ একই মানসিকতার শিকার,  যেখানে প্রতিটি দেশ তার নিজস্ব জিডিপি বৃদ্ধির জন্য উন্মত্ত। স্বয়ংসম্পূর্ণতা, যা বর্তমান বিশ্বে অসম্ভব, সেই লক্ষ্য সামনে রেখে , কিছু ফ্রি ট্রেড চুক্তি সত্ত্বেও প্রতিটি দেশ উচ্চ শুল্ক প্রাচীর নির্মাণে মগ্ন, যা পণ্যের প্রাকৃতিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে জাতীয় ঋণ ক্রমাগত বাড়তে থাকছে এবং অর্থনৈতিক স্রোত আন্তর্জাতিক দেউলিয়াত্ব এবং সংঘাতের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে৷ সর্বশেষ আমাদের সময়ের আরেকটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল যে আমরা প্রচুর বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির কারণে প্রযুক্তির দ্বারা অত্যধিকভাবে প্রভাবিত হয়েছি৷ বস্তুগতভাবে, এটা স্পষ্ট যে আমরা আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের স্তর বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভালই অগ্রগতি করেছি, অনেক সুবিধা হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। পণ্যসামগ্রী, পরিষেবা ইত্যাদি আরও সহজলভ্য হয়েছে. তথাপি সেখানে চরম বৈষম্য রয়েছে যা সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে উসকে দেয়। এজেন্ডা ২০৩০, উদাহরণ স্বরূপ, দাবি করে যে ‘সব ধরনের দারিদ্র্য দূরীকরণ… বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’  কিন্তু এই চ্যালেঞ্জের আসল উৎস আরো গভীরে, এর উদ্ভব ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সেইসব মূল্যবোধের অভাব থেকে  যা সকলের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বে দারিদ্র্যের অস্তিত্বের অনুমতি প্রদান করে। এই আলোকে, দারিদ্র্য শুধুমাত্র বস্তুগত সম্পদের অভাবকে প্রতিফলিত করে না, বরং প্রতিফলিত করে, যে দৃষ্টিতে মানুষ একে অপরকে দেখে, যেভাবে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক গঠন করে, এবং যার ভিত্তিতে একে অপরের মূল্যায়ন করে, সেইসব মূল্যবোধের অভাব। অধিকন্তু, সমগ্র জনগোষ্ঠীর হত্যা ও ধ্বংসের আরও মারাত্মক পন্থা উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের পরিচিত সভ্যতা, নৈতিক আদর্শের অবলুপ্তি এবং বিশ্বের জনগণের উপর প্রকৃত ধর্ম বা মানবধর্মের আধিপত্য শিথিল হয়ে যাবার কারণে, অন্তর থেকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বাহা’ই দৃষ্টিকোণ থেকে, আমরা সকলেই যে বহুমুখী বৈশ্বিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছি তার মূল প্রকৃতি রাজনৈতিক, সামরিক, বা অর্থনৈতিক নয়, বরং নৈতিক। শাসন ​​ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের পুনর্জীবনের জন্য নৈতিক আবশ্যকতায় নিহিত একটি নতুন চেতনা প্রয়োজন। সবশেষে,  কিন্তু গুরুত্বপূর্ণভাবে এটা স্পষ্ট যে সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে অসামঞ্জস্য এবং ঘৃণা পুঞ্জীভূত হয়েছে বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কারের কারণে। প্রতিটি দেশেই শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, জাতি, মতাদর্শ, বর্ণ ইত্যাদি কুসংস্কারের ভিত্তিতে সৃষ্ট পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে জনসংখ্যার এক অংশ অপর অংশকে ঘৃণা করছে, শুধু তাই না একে অপরকে হত্যা করছে। ভারতে শত শত বছরের পুরানো জাতিভেদ প্রথাভিত্তিক বৈষম্যের ভিত আজও সুদৃঢ়। বাহাউল্লাহ প্রায় দেড় শতাব্দী আগে ঘোষণা করেছিলেন: “ঐক্যের ভজনালয় উত্থাপিত হয়েছে তোমরা একে অপরকে অপরিচিত মনে করো না, তোমরা একই বৃক্ষের পত্র আর একই সমুদ্রের জলবিন্দু। একজন মানুষ যেন এই বলে গৌরব না করে সে শুধুমাত্র নিজের দেশকে ভালোবাসে । সে বরং এই বিষয়ে গৌরব করুক যে সে সমগ্র মানবজাতিকে ভালবাসে।” তাঁর কেন্দ্রীয় শিক্ষা হল মানবজাতির একীকরণের দিন এগিয়ে আসছে। সকলকে সকল প্রকার কুসংস্কার দূর করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে যাতে এই গ্রহের সমস্ত দিক থেকে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের চেতনা উদ্ভূত হয়। সমাজের সমস্ত ভিন্নতাকে এক জৈবিক সমগ্রতায় নিলীন করতে হবে। সময় এসেছে সব মানুষের সংমিশ্রণ ও সমন্বয়ের। এটি মানবজাতির অস্তিত্বের অবশ্যম্ভাবী শর্ত। এক গ্রহ, এক মানবজাতি, এই বাহা’ই ধারণার সর্বজনীন স্বীকৃতি ছাড়া মানব জাতির ধ্বংস সুনিশ্চিত। প্রতিটি নেতিবাচক চিন্তাকে ইতিবাচক চিন্তার সাহায্যে প্রতিহত করা সকলেরই দায়িত্ব। বাহা’ই লিখনাবলীতে যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা আমাদের সাহসকে আরও জোরদার করে এবং বিশ্বের উন্নতি এবং পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তির কামনাকারী মহাজাগতিক ইচ্ছার প্রতি আমাদের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে।

লেখক, ডঃ এ.কে. মার্চেন্ট

অনুবাদক, অরিন্দম ঘোষ

(মূল ইংরেজী প্রবন্ধ নর্থইস্ট কালার সংবাদপত্রে ২৬ জুন ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top